ছবি ও মূর্তি (২য় সংস্করণ)
50.00৳
২য় সংস্করণের ভূমিকা
অদৃশ্য বস্ত্তর চাইতে দৃশ্যমান বস্ত্ত মানব মনে দ্রুত প্রভাব বিস্তার করে। সেকারণ অদৃশ্য ব্যক্তি বা সত্তার কল্পনা থেকে মূর্তি ও ছবির প্রচলন ঘটেছে। অবশেষে মূর্তি বা ছবিই মূল হয়ে যায়। ব্যক্তি বা সত্তা অপাঙক্তেয় হয়। যার জন্য মূর্তিপূজায় মূর্তিই মুখ্য হয়, আল্লাহ গৌণ হয়ে যান। মূর্তির অসীলায় আল্লাহকে পাওয়ার মিথ্যা ধারণায় সে জীবন পার করে এবং অর্থ ও সময়ের অপচয় করে। এমনকি কোন কোন হঠকারী ব্যক্তি মূর্তিকে খুশী করার জন্য নিজের স্ত্রী ও সন্তানকেও কুরবানী দেয়। ছবি বা মূর্তির সম্মানের বিনিময়ে সে মানুষ হত্যা করতেও উদ্যত হয়। সেকারণ নূহ (‘আলাহিস সালাম) থেকে মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পর্যন্ত সকল নবী মূর্তিপূজাকে ‘শিরক’ বলেছেন এবং সর্বদা এর বিরুদ্ধে মানবজাতিকে সাবধান করেছেন। এমনকি ‘নবীগণের পিতা’ ইবরাহীম (আঃ) তাঁর সন্তানদেরকে মূর্তিপূজা থেকে রক্ষা করার জন্য আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করে বলেছেন,رَبِّ اجْعَلْ هَذَا الْبَلَدَ آمِنًا وَاجْنُبْنِي وَبَنِيَّ أَنْ نَعْبُدَ الْأَصْنَامَ- رَبِّ إِنَّهُنَّ أَضْلَلْنَ كَثِيرًا مِنَ النَّاسِ فَمَنْ تَبِعَنِي فَإِنَّهُ مِنِّي وَمَنْ عَصَانِي فَإِنَّكَ غَفُورٌ رَحِيمٌ- ‘হে আমার পালনকর্তা, এ শহর (মক্কা)-কে তুমি শান্তিময় কর এবং আমাকে ও আমার সন্তানদের তুমি মূর্তিপূজা থেকে দূরে রাখ’। ‘হে আমার প্রতিপালক! এই মূর্তিগুলি বহু মানুষকে বিপথগামী করেছে। অতএব যে আমার অনুসারী হবে, সে আমার দলভুক্ত। আর যে আমার অবাধ্য হবে, নিশ্চয় তুমি ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (ইবরাহীম ১৪/৩৫-৩৬)।
ভক্তি ও ভালোবাসা হৃদয়ের বিষয়। বাহ্যিকতায় তা বিনষ্ট হয়। ফলে লৌকিকতায় ডুবে গিয়ে এক সময় মানুষ তার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহকে ভুলে যায় এবং তাঁর বিধানকে অগ্রাহ্য করে। নিজেদের হাতে গড়া ছবি-মূর্তির পিছনে সে তার সময়, শ্রম ও অর্থের অপচয় করতে থাকে। অথচ সে ভাল করেই জানে যে, ছবি-মূর্তির ভাল বা মন্দ কিছুই করার ক্ষমতা নেই। তবুও তারা ভাবে যে, এরা আল্লাহর নিকট আমাদের জন্য সুফারিশকারী’ (ইউনুস ১০/১৮)। এভাবে শয়তানের ধোঁকায় পড়ে সে কোন যুক্তিই মানতে চায় না। কারণ ভক্তি যেখানে অন্ধ, যুক্তি সেখানে অচল।
মূর্তিপূজার সূচনা (بدء عبادة الأوثان) : মানবজাতির আদি পিতা আদম ‘আলাইহিস সালাম হ’তে নূহ (আঃ)-এর মধ্যবর্তী সময়ে কিছু ধার্মিক ও নেককার মানুষ খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করেন। নূহ (আঃ)-এর সময়ে তাঁরা মৃত্যুবরণ করলে ইবলীস তাদের ভক্ত-অনুসারীদের প্ররোচনা দিল যে, ঐসব নেককার লোকদের বসার স্থানে তোমরা তাদের মূর্তি স্থাপন কর এবং সেগুলিকে তাদের নামে নামকরণ কর। শয়তান তাদের যুক্তি দিল যে, যদি তোমরা মূর্তিগুলোকে সামনে রেখে ইবাদত কর, তাহ’লে তাদের স্মরণ করে আল্লাহর ইবাদতের প্রতি তোমাদের অধিক আগ্রহ সৃষ্টি হবে। তখন লোকেরা সেটা মেনে নিল। অতঃপর এই লোকেরা মৃত্যুবরণ করলে তাদের পরবর্তীদের শয়তান কুমন্ত্রণা দিল এই বলে যে, তোমাদের বাপ-দাদারা এইসব মূর্তির পূজা করতেন এবং এদের অসীলায় বৃষ্টি প্রার্থনা করতেন ও তাতে বৃষ্টি হ’ত। একথা শুনে তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে সরাসরি মূর্তিপূজা শুরু করে দিল। অতঃপর এভাবেই মূর্তিপূজার সূচনা হয়। পবিত্র কুরআনে নূহ (আঃ)-এর সময়কার ৫ জন পূজিত ব্যক্তির নাম এসেছে। যথাক্রমে অদ, সুওয়া‘, ইয়াগূছ, ইয়া‘ঊক্ব ও নাস্র (নূহ ৭১/২৩)। এদের মধ্যে ‘অদ’ ছিলেন পৃথিবীর প্রথম পূজিত ব্যক্তি যার মূর্তি বানানো হয়’ (ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা নূহ ২৩ আয়াত; বুখারী হা/৪৯২০ ‘তাফসীর’ অধ্যায়)।
পরবর্তীকালে মানুষ ছবি বানাতে শিখলে ছবি, প্রতিকৃতি, স্থিরচিত্র ইত্যাদি এখন মূর্তির স্থান দখল করেছে। মূল ব্যক্তির কল্পনায় এগুলি তৈরী করা হয়। একই ধারণায় সমাধিসৌধ, স্মৃতিসৌধ, প্রতিকৃতি, স্তম্ভ, ভাষ্কর্য, মিনার, বেদী ইত্যাদি নির্মাণ করা হয়। এগুলিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। এগুলির পূজা ও কবরপূজা মূর্তিপূজারই নামান্তর। ছবি-মূর্তি পূজা এবং কবরপূজা ও স্থানপূজার কারণ ও ফলাফল একই। তাই দু’টি বিষয়কে আমরা ১ম ভাগে ও ২য় ভাগে আলোচনা করেছি।
বিগত যুগের মুশরিকরা তাদের মূর্তিগুলি নিজ হাতে বানাতো, সেগুলিকে রক্ষা করত, লালন করত, সম্মান করত, সেখানে ফুল ও নৈবেদ্য পেশ করত। কেউ কেউ এর অসীলায় আল্লাহর নৈকট্য চাইত ও পরকালীন মুক্তি তালাশ করত। বর্তমান যুগের নামধারী মুসলমানরা সেকাজটিই করছে একইভাবে একই ধারণায়। ক্ষুধার্ত ও অভাবগ্রস্ত মানুষকে তারা কিছুই দিতে চায় না। অথচ মৃত মানুষের কবরে বিনা দ্বিধায় তারা হাযারো টাকা ঢালে। ভূমিহীন, ছিন্নমূল মানুষ একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই পায় না। অথচ মাযার, মিনার, স্মৃতিসৌধ ইত্যাদির নামে সারা দেশে শত শত একর জমি জবরদখল ও সরকারীভাবে অধিগ্রহণ করে রাখা হয়েছে। যেগুলি স্রেফ অপচয় ও শিরকের আখড়া ব্যতীত কিছুই নয়। মূর্তিভাঙ্গা ইবরাহীম (আঃ)-এর গড়া কা‘বায় যেমন তাঁর বংশধর কুরায়েশরা মূর্তি দিয়ে ভরে ফেলেছিল, তেমনিভাবে সেখান থেকে মূর্তি ছাফকারী ইবরাহীম-সন্তান শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-এর অনুসারী হবার দাবীদাররা আজ ঘরে-বাইরে সর্বত্র বেনামীতে ছবি-মূর্তি পূজা করে চলেছে। অথচ ‘ইসলাম’ এসেছিল এসব দূর করার জন্য। মানুষকে অসীলাপূজার শিরক থেকে মুক্ত করে সরাসরি আল্লাহর দাসত্বে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য এবং তাকে প্রকৃত অর্থে স্বাধীন মানুষে পরিণত করার জন্য।
আমরা অত্র বইয়ের ১ম ভাগে ‘ছবি ও মূর্তি’র বিরুদ্ধে ২৩টি হাদীছ ও আছার (১১-২১ পৃ.) এবং ২য় ভাগে ‘কবরপূজা ও স্থানপূজা’র বিরুদ্ধে ২০টি হাদীছ ও আছার (২২-৩৮ পৃ.) পেশ করেছি। অতঃপর সেগুলির পর্যালোচনা ও বিদ্বানগণের বক্তব্য তুলে ধরেছি (৫৪-৬০ পৃ.)।
ভারত বিজেতা সুলতান মাহমূদ (৩৪০-৪২১ হি./৯৭১-১০৩০ খৃ.)-কে যখন বিখ্যাত সোমনাথ মন্দির ভাঙ্গার বিনিময়ে অঢেল অর্থ ও মণি-মুক্তা দিতে চাওয়া হয়, তখন তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘হামলোগ বুত শিকান হ্যাঁয়, বুত ফুরোশ নেহীঁ’। ‘আমরা মূর্তি ভাঙ্গা জাতি, মূর্তি বিক্রেতা নই’। অথচ আজ রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যয়ে এসব কাজই করছেন মুসলিম নেতারা। আল্লাহর নিকটে এঁরা কি কৈফিয়ত দিবেন, তাঁরাই ভাল জানেন।
প্রসিদ্ধ আছে যে, ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু (১৮৮৯-১৯৬৪ খৃ.) একবার আজমীরে খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতীর (৫৩৫-৬৩৩ হি./১১৪১-১২৩৬ খৃ.) মাযারে গিয়ে সমবেত ভক্তদের উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে বলেছিলেন, ‘ভাইয়ো! হিন্দু আওর মুসলিম ভারত মাতা কে দো সন্তান হ্যাঁয়। দূনূঁ মেঁ কোয়ী ফারক্ব নেহী হ্যাঁয়। স্রেফ এহী কে হিন্দু আপনে দেওতাঊঁ কো সামনে রাখ্ কে পূঁজতে হ্যাঁয়, আওর মুসলিম আপনে দেওতাঊঁ কো মেট্টী কে নীচে ঢাঁপ কে পূঁজতে হ্যাঁয়’ (ভাইয়েরা আমার! হিন্দু ও মুসলিম ভারত মাতার দুই সন্তান। দু’জনের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। কেবল এতটুকু যে, হিন্দু তাদের দেবতাকে সামনে রেখে পূজা করে। আর মুসলমান তাদের দেবতাকে মাটির নীচে (কবরে) ঢেকে পূজা করে’।
হে মুসলিম! এর চাইতে আর কি গালি তুমি শুনতে চাও! হ্যাঁ, একেই বলে মিছরীর ছুরি। অতএব আমরা সংশ্লিষ্ট সকলকে অনুরোধ করব এসব শিরকী কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকার জন্য এবং আল্লাহর গযব থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করার জন্য। কেননা আল্লাহ বান্দার সব গোনাহ মাফ করেন, কিন্তু শিরকের গোনাহ মাফ করেন না (নিসা ৪/৪৮, ১১৬)। পরকালে এসব লোকের জন্য আল্লাহ জান্নাতকে হারাম করেছেন (মায়েদাহ ৫/৭২)। অতএব হে জাতি! ছবি-মূর্তি এবং কবর ও স্থানপূজা থেকে সাবধান হও!!
Only logged in customers who have purchased this product may leave a review.
Reviews
There are no reviews yet.